ডেঙ্গু জ্বর হলো একটি ভাইরাসের নাম। এই ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করার ৭ থেকে ১৪ দিন পর শরীরে জ্বর আসে। তারপর আসতে আসতে আরো অনেক লক্ষণ প্রকাশ পায়। কিন্তু সময় মত এর চিকিৎসা না নিলে এই ভাইরাস আপনার জীবন কেড়ে নিতে পারে। ডেঙ্গু ভাইরাস সাধারণত এডিস মশার মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। আর একে ডেঙ্গু জ্বর নামেও পরিচিত।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ গুলো কি ?
একটা কথা বলে রাখা ভালো যে, আমাদের শরীরে ৩ ধরনের রক্ত থাকে। এই রক্ত দেখতে কিছুটা ক্যান্ডি চকলেটের মত দেখতে। কিন্তু এগুলো খালি চোখে দেখা যায় না। আর ডেঙ্গু জ্বর হলে আমাদের শরীরের এই রক্তের চাকা গুলো ভেজ্ঞে যায়। ফলে কয়েক ঘন্টার মধ্যে রক্ত নষ্ট হয়ে মানুষ মৃত্যুর দিকে ঝুকে পড়ে।
- প্রচন্ড জ্বর উঠা
- অতিরিক্ত মাথাব্যথা করা
- শরীরে মাংসপেশি ও হাড়ের জয়েন্টে ব্যথা করে
- চোখের পেছনে অতিরিক্ত ব্যথা করা
- শরীর অনেক বেশি ক্লান্তি ও দুর্বল হয়ে পড়ে
- সব সময় বমি বমি ভাব বা বমি হয়
- কোনকিছু খেতে ইচ্ছে করে না
- অনেক সময় গায়ে ফুসকুড়িও উঠে
- গুরুতর হলে মুখ ও নাক দিয়ে রক্তপাত হতে পারে
- মাড়ি দিয়ে রক্তপাত হতে পারে
- বিনা কারণে পেটে ব্যথা ও পেট জ্বালা-পোড়া করে
- অনবরত পাতলা পায়খানা বা ডায়রিয়া হতে পারে
- শরীরের রক্তচাপ কমে যাওয়া
- শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে
- জ্ঞান হারানোর মত সমস্যা হতে পারে
আপনার জ্বর হওয়ার পর যদি উপরের লক্ষণ গুলোর মধ্যে কোনো একটি লক্ষণ দেখা দেয়। তাহলে যত দ্রুত সম্ভব হাস্পাতালের গিয়ে ডেঙ্গু টেস্ট করে তারপর ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করবেন। কারণ, ডেঙ্গু জ্বর কোনো সাধারণ জ্বর না, এই জ্বর ২ থেকে তিন দিনের মধ্যে আপনার জীবন কেড়ে নিতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বর হলে করণীয় কি ?
জ্বর নির্ণয়ঃ- ডেঙ্গু জ্বর হলে সাধারণত প্রচন্ড জ্বর, বিনা কারণে মাথাব্যথা, পেট জ্বালা-পোড়া, গায়ে ব্যথা, বমি হওয়া এবং চোখের পেছনে ব্যথা হয়। তাই এই লক্ষণের একটিও দেখা দিলে ডাক্তার দেখিয়ে রক্ত পরীক্ষা করে ডেঙ্গু নির্নয় করে তারপর ওষুধ সেবন করবেন।
তরল খাবার খানঃ- ডেঙ্গু জ্বর হলে আমাদের শরীর থেকে প্রচুর পরিমান পানি বেরিয়ে যায়। ফলে পানি শূন্যতা দেখা দিতে পারে। তাই সব সময় বেশি পরিমাণে লেবুর শরবত, ORS স্যালাইন, ডাবের পানি অথবা ফলের রস খেতে হবে। এর মধ্যে থেকে যেকোনো একটি দিনের ৫ থেকে ৬ বার খাবেন।
প্লেটলেট পরীক্ষাঃ- ডেঙ্গু জ্বর হওয়ার ৩য় দিন পর থেকে ২৪ ঘন্টায় একবার করে প্লেটলেট পরীক্ষা করতে হবে। কারণ, ডেঙ্গু জ্বর হলে রক্তের প্লেটলেটের সংখা কমে যায়। যার ফলে মানুষ মৃত্যুর দিকে ঝুকে পড়ে। প্লেটলেট ১ লক্ষ্য ৫০ হাজারের নিচে নেমে গেলে দ্রুত হাস্পাতালের ভর্তি হতে হবে।
সেহেতু ডেঙ্গু জ্বর সাধারণ জ্বরের মত না যে নাপা বা নাপা এক্সট্রা খেলেই ভালো হয়ে যাবে। তাই ডেঙ্গু জ্বর হলে খুবই সাবধানে খাওয়া-দাওয়া, চলা-ফেরা করতে হবে। তাছাড়া ডেঙ্গু জ্বরের আলাদা কোনো ওষুধ নেই। তাই আরো বেশি সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে। উপরে ডেঙ্গু জ্বর হলে করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করা হলো। এগুলো মানার পাশাপাশি বেশি বেশি বিশ্রাম নিতে হবে।
ডেঙ্গু জ্বর কত দিন থাকে ?
সাধারণ জ্বর ২ থেকে ৭ দিন স্থায়ী হয়ে থাকে। কিন্তু ডেঙ্গু জ্বর এর থেকে কিছুদিন বেশি হতে পারে। যেমনঃ- ৫ থেকে ১৪ দিন। কারণ, ডেঙ্গু ভাইরাস শরীরে প্রবেশের পর থেকে ৭ থেকে ১০ দিন পর ডেঙ্গু জ্বর দেখা দেয়। তবে প্রাথমিক অবস্থায় ডেঙ্গু নির্নয় করে সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিলে ৫ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ইনশাআল্লাহ আপনার ডেঙ্গু জ্বর ভালো হয়ে যাবে।
তবে ক্ষেত্র বিশেষে ডেঙ্গু জ্বরের স্থায়িত্ব আরো বেশি হতে পারে। এটা জ্বরের তীব্রতা, স্থায়িত্ব, রোগীর বয়স, রোগীর স্বাস্থ্যের অবস্থা এবং ডেঙ্গু ভাইরাসের ধরন উপর নির্ভর করে। কারণ, সবার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এক রকম না। কারো বেশি কারো আবার কম।
ডেঙ্গু জ্বর হলে কি খেতে হবে ?
ডেঙ্গু জ্বর মারাত্মক একটি রোগ। এটি ‘এডিস ইজিপ্টি’ নামের মশার মাধ্যমে ছড়ায়। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে রক্তের প্লেটলেট সংখ্যা কমে যায়, শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয় এবং রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে এই সমস্যার সমাধান পেতে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রমণ রোগীর খাদ্য তালিকায় কিছু পরিবর্তন আনতে হবে।
তরল খাবারঃ- ডেঙ্গু জ্বর হলে রোগীকে বেশি বেশি তরল খাবার খাওয়াতে হবে। কারণ, ডেঙ্গু জ্বর হলে রোগী শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়, আর এই তরল খাবার দেহের পানিশূন্যতা দূর করে। তাছাড়া তরল খাবার খেতেও সহজ এবং পুষ্টিগুনে ভরপুর। তরল খাবার হলোঃ- লেবুর শরবত, ডাবের পানি, ORS স্যালাইন এবং ভেজিটেবল স্যুপ ও ফলে রস।
ভিটামিন সি ও আয়রনঃ- ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও রক্তের প্লেটলেট সংখ্যা কমে যায়। ফলে নিয়ম ভিটামিন সি ও আয়রন যুক্ত খাবার খেতে হবে। কারণ, ভিটামিন সি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। আর আয়রন শরীরে রক্ত উৎপাদন করতে কাজ করে থাকে। ভিটামিন সিঃ- কমলা, লেবু, জাম্বুরা আনারসও এবং আয়রনঃ- , ডিম, ডালিম, মিষ্টিকুমড়ার বিচি, বিট জুস, খেজুর, কিশমিশ ইত্যাদি।
আশা করি আপনি পরিপূর্ণ একটি ধারণা পেয়েছে যে, ডেঙ্গু জ্বর হলে কি খেতে হবে। আশা করি উপরের এই খাবার গুলো খেলে আপনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন। তবে এর পাশাপাশি বেশি বেশি বিশ্রাম নিতে হবে। পাশাপাশি ঘরে বসে বসে ছোট খাটো অল্প পরিচ্ছমী কিছু ব্যায়াম করতে হবে।
ডেঙ্গু জ্বর হলে কি গোসল করা যাবে ?
আগের যুগের ডাক্তাররা জ্বর হলে গোসল করতে নিশেধ করতেন। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে যে জ্বর নিয়ে গোসল করলে অনেক উপকার পাওয়া যায়। কারণ, জ্বর হলো গরম, আর পানি হলো ঠান্ডা। তবে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তিরা গোসল করার সময় কিছু সতর্কতা অবলম্বন করে গোসল করতে হবে।
গোসল করার সময় যা করবেনঃ-
- গোসলের সময় ঠান্ডা বা বেশি গরম পানি ব্যবহার করা যাবে না। গোসল করতে হবে কুসুম গরম পানি দিয়ে।
- লম্বা সময় ধরে শরীরে পানি ঢালা যাবে না। কারণ, এতে জ্বর আরো বাড়তে পারে এবং শরীর দুর্বল হয়ে যেতে পারে।
- গোসলের পরপর ভালো করে শরীরের পানি মুছে ফেলতে হবে। কারণ, ভিজে শরীরে দীর্ঘক্ষণ থাকলে ঠান্ডা লাগতে পারে।
- গোসলের পর খাবার খেয়ে দীর্ঘ একটি ঘুম দিবেন। এতে আপনার শরীরে এনার্জি চলে আসবে এবং জ্বর অনেকটায় কমে যাবে।
কখন গোসল করা যাবে নাঃ-
- যখন শরীরে জ্বর অনেক বেশি থাকবে, তখন ভুলেও গোসল করা যাবে না। কারণ, এতে ঠান্ডা, কাশি এবং জ্বর বাড়তে পারে।
- শরীর যখন খুব দুর্বল থাকবে, তখন গোসল করা যাবে না। কারণ, গোসলের অনেক বেশি ক্যালোরি খরচ হয়।
এই নিয়ম গুলো মেনে যেকোনো জ্বরে আক্রান্ত রোগী গোসল করতে পারবে। তবে একটি কথা মাথায় রাখবেন যে, গোসল করতে শরীরের ক্যালোরি খরচ হয়। তাই গোসলের পরপর কিছু খাবার খেয়ে ওষুধ সেবন করে একটি ঘুম দিবেন। ঘুম থেকে উঠে দেখবেন আপনার জ্বর ৭০ পার্সেন্ট ভালো হয়ে গেছে ইনশাআল্লাহ।
ডেঙ্গু জ্বর কি ছোঁয়াচে রোগ ?
ডেঙ্গু জ্বরের অপর নাম আতংক। এজন্য অনেকেই ধারণা করে যে ডেঙ্গু জ্বর মনে হয় ছোঁয়াচে রোগ। যারা এই ধারণা করে, তাদেরকে বলছি। ডেঙ্গু জ্বর কোনোভাবেই ছোঁয়াচে রোগ না। কারণ, এটা হচ্ছে একটি ভাইরাস জনিত রোগ। আর এই ভাইরাসটা এডিস নামের মশার মাধ্যমে ছড়ায়। আপনাকে যতক্ষণ না এই মশায় কামড়াবে, ততক্ষণ আপনার ডেঙ্গু জ্বর হবে না।
যেহেতু ডেঙ্গু জ্বর একটি মশা বাহিত রোগ। তাই আপনি যদি কোন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহারিত জিনিসপত্র ব্যবহার করেন। তাহলে আপনার কোনো সমস্যা হবে না। আপনি যদি ডেঙ্গু জ্বর থেকে বাচতে চান, তাহলে আপনার আশপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রাখুন এবং ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করুন।